মালয়েশিয়ায় সপ্তাহে শনিবার ও রবিবার ছুটি থাকায় আমরা চেষ্টা করি ছুটির দিনগুলো একটু সুন্দরভাবে কাটানোর। সেটা হতে পারে নতুন কোনো জায়গা, পূর্বে ভ্রমণ করা স্থান, কিংবা কোনো ভালো রেস্টুরেন্ট। মূলত, আমরা চাই আমাদের সময়টা স্মৃতিময় হয়ে থাকুক। শুধু আমি আর আমার হাসব্যান্ড নই, মালয়েশিয়ায় আমাদের এক্সপ্যাটস গ্রুপের কিছু ঘনিষ্ঠ পরিবারও একসঙ্গে সময় কাটাই। যেদিন সবাই ফ্রি থাকে, সেদিন আমরা পরিকল্পনা করি কোথাও ঘুরতে যাওয়ার।
গন্তব্য: ইপোহ, পেরাক
সেরকম এক সপ্তাহে আমাদের গন্তব্য ছিল পেরাকের ইপোহ, যা কুয়ালালামপুর থেকে প্রায় ২০৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আমরা সকালের দিকেই যাত্রা শুরু করি। গাড়িতে যেতে আমাদের সময় লেগেছে প্রায় ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট, তবে থেমে থেমে যাওয়ায় সময় কিছুটা বেশি লেগেছে।
আপনারাও চাইলে ইপোহ যেতে পারেন বাস, ট্রেন, বা বিমানযোগে:
- বাস: KL Sentral থেকে RedBus পোর্টালের মাধ্যমে আগেভাগেই টিকিট বুক করা যায়। বেশিরভাগ বাস ছাড়ে TBS (Terminal Bersepadu Selatan) থেকে, তবে কিছু বাস KL Sentral থেকেও যায়। প্রতি টিকিটের দাম ২৫ রিঙ্গিত থেকে শুরু।
- ট্রেন: KL থেকে Ipoh নন-স্টপ ট্রেন পরিষেবা রয়েছে (সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা)। এতে খাবার এবং WiFi-ও থাকে। ট্রেনের টিকিট ৪৫ রিঙ্গিত। KL Sentral থেকে ট্রেন ছাড়ে।
- বিমান: Kuala Lumpur (KUL) থেকে Ipoh (IPH) ফ্লাইট পাওয়া যায়, যার ভাড়া ১৬০ রিঙ্গিত থেকে শুরু। তবে KL থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার অতিরিক্ত খরচও আছে, তাই আমি ট্রেন বা বাসকেই বেশি সুবিধাজনক মনে করি।
ইপোহ শহর ও দর্শনীয় স্থান
ইপোহ শহর তার পুরনো স্থাপত্যশৈলী, ইতিহাস, চীনা শপহাউস, স্ট্রিট আর্ট এবং ট্রেন্ডি কফি শপের জন্য পরিচিত। এছাড়াও, এখানে রয়েছে মনোরম চুনাপাথরের পাহাড়, গুহা এবং গরম পানির ঝর্ণা।
সকালবেলা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ব্রেকফাস্ট
আমরা সকালে যাত্রা শুরু করেছিলাম, তাই পথিমধ্যে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ি। একটি RNR (Rest & Relax) স্টপে থেমে KFC-তে বার্গার ও চিকেন খেয়ে নেই। জায়গাটি ছিল খুবই সুন্দর, তাই আমরা কিছু ছবি তুলে Google Maps-এ রিভিউ লিখলাম।
কেলি’স ক্যাসেল (Kellie’s Castle) - এক রহস্যময় স্থাপনা
আমাদের প্রধান আকর্ষণ ছিল Kellie’s Castle। এই স্থাপনাটি একটি অসমাপ্ত প্রাসাদ, যা স্কটিশ প্ল্যান্টার উইলিয়াম কেলি-স্মিথ তার স্ত্রী অথবা ছেলের জন্য নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। বিদেশি পর্যটকদের জন্য প্রবেশ মূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ১০ রিঙ্গিত এবং শিশুদের জন্য ৮ রিঙ্গিত।মালয়েশিয়ানদের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের ৫ রিঙ্গিত এবং শিশুদের ৩ রিঙ্গিত।
আমরা ক্যাসেল ঘুরে দেখলাম এবং আশেপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এই স্থাপনার ইতিহাস এবং পরিবেশ আমাদের মুগ্ধ করেছে। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম, বেশ একটা হরর/ ভৌতিক ফিলিংস হচ্ছিল। আমার হাসবেন্ড তো হরর মুভি দেখতে পারে না, সেখানে বাস্তবে এরকম হরর জায়গা দেখে সে একটু চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল এবং বারবার বলছিল বেশি থাকা যাবে না এখানে।
আমি জোর করেই সব জায়গায় নিয়ে ঘুরালাম, আমার এরকম পুরোনো বিল্ডিং ও তার ইতিহাস বেশ ভালো লাগে। বেশ অনেকটা সময় কাটালাম, ছবি তুলে, ভিডিও করে Maps-এ আপলোড করলাম।সেখান থেকে কিছু ম্যাগনেটিক সুভেনিরও কিনলাম।সেদিন খুবই গরম ছিল, তাই সবাই সেখানে জুস পান করে রওনা দিলাম ইপোহ শহরের দিকে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি
ইপোহ শহরে যাওয়ার পথে আমরা আরও কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখি,এর মধ্যে ৩টি জায়গার নাম দিলাম।
এই স্থানগুলোতে গ্রামীণ সৌন্দর্য, গুহা এবং কিছু মন্দির দেখা যায়।
ইপোহ ওল্ড টাউন ও স্ট্রিট আর্ট
ইপোহ শহরে প্রবেশের পর আমরা ওল্ড টাউন ঘুরে দেখি। সেখানে প্রাচীন স্থাপত্য, ওয়াল পেইন্টিং ও স্ট্রিট আর্ট ছিল, যা দেখেই খুব ভালো লাগছিল । এরপর “Ipoh WoW” লিখার সামনে দাঁড়িয়ে অনেক ছবি তুলি আর সেখানে অনেক কবুতর ছিল, তাদেরকে খাবার খাওয়াই - দারুণ এক অভিজ্ঞতা !
তারপর চলে যাই বিশাল সবুজ মাঠে, যা - Ipoh Iconic Field বা Padang Ipoh-নামে পরিচিত ; সেখানে বসে গল্প করলাম এবং বিখ্যাত Nasi Goreng Ayam খাবার উপভোগ করলাম।সেখানে এক পাশে St Michel’s Institution এবং Royal Ipoh Club ছিল। এরপর এনার্জি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আশেপাশের সবকিছু ঘুরে দেখার জন্য।
আমরা নিম্নলিখিত ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরে দেখি:
- Ipoh Heritage Trail
- War Memorial, Ipoh
- Birch Memorial Clock Tower
- Sultan Idris Shah II Mosque
- Han Chin Pet Soo
- Ipoh Old Town
- Dato Panglima Kinta Mosque
- Hong Kong & Shanghai Bank Building, Ipoh
- Standard Chartered Bank Building, Ipoh
- Mercantile Bank Building, Ipoh
- Kapitan Chun Thye Phio Building
- Ipoh Upside Down World
- এবং আরও অনেক স্থাপনা।
উপরের সব জায়গা ঘুরে দেখতে দেখতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, অনেক বিল্ডিংয়ের অদ্ভুত নাম দেখছিলাম। পুরনো টাউন আর আর্ট দেখে মনে হচ্ছিল আমি যেন অনেক বছর আগে চলে গিয়েছি… আসলে স্ট্রিট আর্ট অনেক কথা বলে, সেদিন সেটা বুঝেছিলাম।
রাতের মনোরম কিনতা রিভারফ্রন্ট ওয়াক (Kinta Riverfront Walk)
শেষে আমরা গিয়েছিলাম Kinta Riverfront Walk-এ, যেখানে ১০০০-এর বেশি আলো জ্বলজ্বল করে। এটি মূলত রাতের জন্য উপযুক্ত স্থান, যেখানে গাছগুলো নানা রঙের আলোয় আলোকিত হয় এবং এটি একটি স্বপ্নময় পরিবেশ তৈরি করে। এখানে সাইকেল ভাড়া নিয়ে ঘোরা যায়।
আমরা রাত ৯টায় ইপোহ থেকে কুয়ালালামপুর ফেরার পথে রওনা দেই এবং রাত ১১:৩০ নাগাদ বাড়ি পৌঁছাই। রাতের রাস্তা বেশ উপভোগ্য ছিল, তাই দীর্ঘ যাত্রাও ক্লান্তিকর লাগেনি।
আপনাদের সাথে আমার মালয়েশিয়ার ট্রিপের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে খুব ভালো লাগলো। লেখায় কিছু ভুল থাকতে পারে, তবে লিখতে গিয়ে যেন আবারও ইপোহ ঘুরে এলাম! ৬৮৪ টি ছবি তুলেছিলাম, কিন্তু এতো শেয়ার করতে পারলাম না, কিছু ছবি শেয়ার করলাম, আমার একার সব ছবির ফটোগ্রাফার ছিল আমার হাসব্যান্ড @PavelSarwar
আপনারাও যদি ইপোহ যান, তাহলে আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে ভুলবেন না, সেই সাথে সানগ্লাস আর পর্যাপ্ত পানি সাথে রাখবেন !